সে যে আছে, যায় না চেনা
ভরদুপুরে চাঁদের গাড়িতে চেপে বসলো আলোক।
গ্রামের একটি স্কুলে মাষ্টারি করে সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাষ্টার্স করার পরই সে চলে গেছে
গ্রামে। অন্য অনেকের মত ঢাকায় থাকার বাসনা তার কখনোই ছিল না। পত্রিকার
শ্রেণীবদ্ধ ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন দেখে সরাসরি চলে গেল কার্পাসডাঙ্গায়।
সীমান্ত লাগোয়া এই গ্রামটিতে গিয়েই অদ্ভুত এক ভালো লাগা তাকে আচ্ছন্ন করে
রাখলো। বড় বড় তাল গাছ, মেঘের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে মাথা। হাত-পা ছড়িয়ে
ছায়া দিচ্ছে বটপাকুড় গাছ। বিজ্ঞাপন অনুসারে মৌখিক পরীক্ষা দিলো সে, স্কুল
কমিটির সভাপতি বললো, আপনি তো এখানে থাকবে না, তাহলে পরীক্ষা দিচ্ছেন কেন।
আমরা আবার বিজ্ঞাপন দিতে পারবো না। আমাদের এত টাকা নেই। আলোক তাদেরকে
স্পষ্ট করে জানালো পেট চালানোর মত টাকা পেলেই সে এখানে থাকবেঃ. অনেক অনেক
দিন। আলোকের চাকরিটা হয়ে গেল।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে,
শীতের ছুটির একদিন কোন কিছু না ভেবেই সে চড়ে বসলো ঢাকার বাসে। গাবতলীতে
নেমে একবার ভেবেছিল ইউনির্ভাসিটিতে গিয়ে কোন এক বন্ধুর রুমে উঠবে। বন্ধুরা
কেউ কেউ আরও পড়ালেখার জন্য এখনো ক্যাম্পাস ছাড়েনি। অথবা ক্যাম্পাস তাদের
ছাড়েনি। না আলোকের সেখানে যাওয়া হলো না। চট্টগ্রামের দিকে ছেড়ে যাচ্ছিলো
একটি বাস। তাতে সওয়ার হলো সে। জানে না কোথায় যাবে। তার খোঁজ কেউ রাখে না।
যে রাখতো মানে নাগমা, সে এখন হাজারো ক্রোশ দূরে, স্বামী সংসার নিয়ে
আমর্ষ্ট্রাডামে হয়তো বেশ আছে; নাগমা কি কখনো তাকে ভালোবেসেছিল?
কাপার্সডাঙ্গার তার ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে সবুজ ধানের দোল খাওয়া দেখে
অনেকবার ভেবেছে সে, উত্তর পায়নি। অথবা সে জানেই না ভালোবাসা কাকে বলেঃ
চট্টগ্রাম এসেই এবার কী করা যায়, সকালে
ছোট্ট একটি হোটেলে ঝাল গরুর মাংস দিয়ে পরোটা খেতে খেতে সিদ্ধান্তটা নিয়েই
ফেললো সে। মুরাদপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে খাগড়াছড়ির বাসে উঠে পড়লো। ছোট ছোট
বাস। গাদাগাদি মানুষ। সিগারেটের উটকো গন্ধ, না আলোকের সে গন্ধ খারাপ লাগে
না। গ্রামে দুই একবার হুক্কোতে পিউরিফাইড ধোঁয়ায় টান দিয়ে সে বুঝেছিল, বেশ
মজা আছে। কিন্তু তার নেশা লাগেনি।
খাগড়াছড়িতে নেমেই তার মন খারাপ হয়ে
গেল। আবার শহর। না এখানে থাকা যাবে না। বরং অনেক গভীরে যেতে হবে। একটি
পত্রিকার দোকানে জিজ্ঞাস করে জেনে নিলো কোথায় যাওয়া যায়। নানা জায়গার খবর
পাওয়ার পর মারিশ্যা যাবে সিদ্ধান্ত নিলো। আর ঐ লাইনের একটি চাঁদের গাড়িতে
চেপে বসলো সে। তখন ভর দুপুর। জিপ গাড়িতে মুড়ি বোঝাই করার মত মানুষ ভরা
হয়েছে। আলোক বসেছে ভিতরে। এই গাড়ির ছাদে বাম্পারেও মানুষ। আলোকের পাশে
একটি মেয়ে বসেছে। পাহাড়ী পোশাক। ওড়নাটা খুব সুন্দর। একটু হেসে সে মেয়েটিকে
বললো সে মারিশ্যা যেতে চায়। মেয়েটি বললো সেও যাচ্ছে। ও বললো একটু সাহায্য
করার জন্য। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। পথে দুই একবার গাড়ি থামিয়ে চেক করলো
উর্দী পরা লোকেরা। কেন এই তল্লাশী? এটা কি বাংলাদেশ নয়। এখানে কি স্বাধীন
বাংলাদেশের মানুষ থাকে না ?
আকাঁবাকাঁ পাহাড়ী সরু পথ দিয়ে চলছে জিপ
গাড়িটি। মাঝে মাঝে মানুষ নামছে। উঠছে। দুপুরের গরমটা এই শীতেও বেশ জেঁকে
বসেছে। ঘন্টা দেড়েক পরে এক চিলতে নদীর পাশে এসে গাড়িটি থামলো। জায়গাটাকে
বলে মারিশ্যা স্টেশন।
মেয়েটি বললো
: আপনাকে এখানে নামতে হবে।
অন্য অনেকের মত তারাও নেমে পড়লো। মেয়েটি মেনেই হাঁটতে শুরু করলো।
আলোক ডাকলো, বললো
: শুনুন, আমি এখানকার কিছু চিনি না। আমি ঘুরতে এসেছি
: তো আমি কী করতে পারি?
: আপনি জানেন, এখানে সবচেয়ে ঘন জঙ্গলটা কোন দিকে।
: জঙ্গলে এভাবে যাওয়া যায় না। একা একা। তাছাড়া আপনি থাকবেনই বা কোথায়। বনে তো আর এমনি এমনি থাকা যায় না।
:যায়, আমি থাকতে পারবো। একটা বড় গাছের নীচে। যেখানে মাটি আলো না পেয়ে কালো হয়ে গেছে।
মেয়েটি ফিক করে হেসে দিলো। এতক্ষণ তার হাসি দেখেনি সে। বললো
: আপনি জানেন জঙ্গলে বাঘ আছে, ভাল্লুক আছে।
:থাকুক, আমাকে খাবে না। আমার মাংস মজাদার নয়। স্কুল শিক্ষকের মাংস মজা হয় না। বাঘ ভাল্লুককে ছাত্র বানিয়ে নেবো।
: জোঁক আছে !
: একটা জোঁক আর কত রক্ত খায় বলুন?
: আপনার দেখছি ভয় ডর নেই। আমার সাথে বাঘাইছড়ি যেতে পারেন। ওখানটায় পাহাড়ের জঙ্গল বেশ গভীর।
: আপনি যদি অনুমতি দেন।
: দেখুন আমিও একটি স্কুলে পড়াই, জাতিভাই বলে একটা কথা আছে না। আমাদের নৌকায় যেতে হবে। অনেকটা পথঃ
নৌকায় চলতে চলতে কথা হলো দু’জনের। জেনে নিলো যে যার নাম।
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টির সময় নৌকা চলবে না। আসে আসে করে বৃষ্টিটা এসেই পড়লো।
ঘন কালো মেঘের পুরু ফোটার বৃষ্টি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। একটি ছাউনি মত জায়গায় এসে থেমেছিল। সন্ধ্যা
হচ্ছে। নৌকার যাত্রীরা যে আট দশজন ছিল, তাদের বেশিরভাগই চলে গেছে আশেপাশে
থাকা কোন আতœীয়-স্বজনের বাড়ি। এখানে আলোক বা সুপর্ণার কেউ নেই।
ছাউনির তলায় বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছে।
দুইজন জানে না এখানে কি করে পুরো রাত থাকবে। আর এই বৃষ্টি যে সারা রাতে
ছাড়বে না, তা সেখানে থাকা চার পাঁচজনের সকলেই বুঝতে পারছে। নিজের পিঠব্যাগ
থেকে একটা চাদর বের করলো আলোক। চট্টগ্রাম থেকে কেনা চানাচুরের প্যাকেটা।
কোন প্রশ্ন না তুলে চানাচুর খেয়ে নিলো সূপর্ণা।
রাত বাড়ছে। শীত বাড়ছে। এমন সময় এতো
গভীর বৃষ্টিপাত, রাতের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলো আলোক। কড়া শাসনের সুরে
সুপর্ণা বারণ করলো। সেই বারণ টপকে বৃষ্টিতে ভেজার সাধ্যি ছিল না আলোকের।
: আপনি ঢাকা থেকে পাস করে কেন গ্রামে চলে গেলেন?
: সবাই তো শহরে থাকে। আমি চাইছি অন্তত একজনকে মানুষ বানাতে। তাহলেই আমার মিশন সাকসেস।
: বিয়ে করেছেন, অত্যন্ত এই ব্যক্তিগত প্রশ্নটি করার মত আমাদের সম্পর্ক হয়েছে, কি বলেন?
: না বিয়ে থা করা হয়নি। গত বছর পাস
করলাম। প্রায় এক বছর হলো চাকরি করছি। আর বিয়ের জন্য যে অর্থবিত্ত থাকতে
হয়, তা আমার নেই। চাল-চুলো ছাড়া একটা জীবনের সঙ্গে কোন জীবন এসে জড়ো হতে
চাইবে, বলুন?
: খুঁজুন, পেয়ে যেতে পারেন।
: খাগড়াছড়ি কলেজ থেকে পাস করে এখানে ছাত্র পড়াতে কেমন লাগছে?
পাল্টা প্রশ্নের জবাবের উত্তর পাহাড়ী মেয়েটি দিলো হেসে। কোন শব্দ উচ্চারণ না করে।
: বাড়িতে কে আছে?
: মা। বাবা কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন।
রাত কালো হচ্ছে। নিকষ কালো রাত।
পাহাড়ের জঙ্গল থেকে নানা শব্দ হচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে সূপর্ণার। পাহাড়ী রাতের
দৃশ্য একটু অন্যরকম। ছাউনিটা একটু বড় বলে যে যার মত স্থান করে নিয়েছে।
হাতের চাদরটি সূপর্ণার হাতে দিয়ে বললো এটা জড়িয়ে ঘুমিয়ে নিন। আমি আপনাকে
পাহারা দিচ্ছি।
: আপনার শীত লাগছে না।
: আমি তো মোটা একটা কাপর পরে আছি। কোন সমস্যা হবে না।
মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছিল। আলোক মেয়েটিকে
অন্ধকারে দেখছে। অন্ধকারের নিজস্ব যে একটা আলো থাকে সেই আলো দিয়ে। রাত
বাড়ছে। বৃষ্টি বাড়ছে। বাড়ছে নানা ধরনের প্রাণীর হাঁকডাক। এক সময় ঘুমিয়ে গেল
আলোক।
উত্তাপটি তার বেশ ভালো লাগছে। এখন কেমন
যেন শীত কমে গেছে। অদ্ভুত সুন্দর একটি গন্ধ পাচ্ছে আলোক। কেউ তাকে জড়িয়ে
ধরেছে। মেঘের বিশাল গর্জনে ঘুম ভেঙ্গে গেল আলোকের। না নড়তে পাচ্ছে না সে।
কখন যে তাকে চাদরের তলে নিয়ে এসেছে মেয়েটি, জানে না সে। এক চাদরে বুকের
মধ্যে আটকে রেখেছে তাকে। প্রথমবারের মত কোন মেয়ের বুকে লেপ্টে আছে সে।
উত্তাপ আসছে। এমন উত্তাপ আগুনে আসে না, আসে না রুম হিটারেও। আর সেই সুন্দর
অদ্ভুত গন্ধঃ কোন মেয়ের শরীরে এত সুন্দর গন্ধ থাকতে পারে কোনদিন চিন্তাও
করেনি সে। অবশ্য কোন নারীর বুকে নিজেকে লুকিয়ে রাখার সৌভাগ্য তার আগে
হয়নি। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমের রাজ্যে চলে গেল আলোক।
সকালের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো আলোকের।
সূপর্ণা দূরে তাকিয়ে আছেঃ
ও উঠেছে দেখেই বললো
: রাতে বেশ জ্বর এসেছিলো আপনারঃ। বৃষ্টি নেই, আবার নৌকা ছাড়বে।
বুনো গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ভোরের বাতাসে। মেয়েটিকে দেখছে সেঃ
নৌকা ছেড়ে দিলো।
সুপর্ণার বাড়িতে দুই রাত ছিল।
নাপ্পি শুঁটকির তরকারী খেয়েছিল।
ফিরে আসবার সময় যে যার ঠিকানা বিনিময় করলো।
: আবার কবে আসবেন, এমন প্রশ্নের উত্তর জানে না আলোক।
কুল কুল করে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদীতে নৌকা ভেসে চলছিল। কোন বাঁক না নেয়া পর্যন্ত হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছিল মেয়েটি।
****
এরপর প্রতি সপ্তাহে চিঠি বিনিময় হতো।
একদিন দুই দিন করেঃ অনেকদিন। কত যে কথা। কত যে অভিমান। কত যে প্রেম। দুজন
দুজনকে ভালোবেসে ছিল। কিন্তু সবার জীবন তো এক রকম নয়। আলোকের জীবনও একটু
ভিন্ন রকম। সূপর্ণাকে এক চিঠিতে সে জানিয়ে দিলো, তার পক্ষে হয়তো ঘর করা
হয়ে উঠবে না। তাই ভুলে যেন যায়, তাকেঃ
অনেকদিনের চিঠি বিনিময়ে সূপর্ণা বুঝে গিয়েছিল কেমন সোজাসাপ্টা ভাবে কঠিন কথা বলে দিতে পারে আলোক।
ঘর করার স্বপ্নের কথা জানিয়ে যে চিঠিটি সাদা খামে সূপর্ণা দিয়েছিল, তাতে সে বলেছিলঃ
: আলোক তুমি দুঃখ ভালোবাসো। আমি সুখ। ভালো থেকো!
আলোকরা ভালো থাকতে পারে না।