অশনি সংকেত
সুনয়না
মেয়েটির নাম
অনেক পরে জেনেছিল পান্না। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি হতে জার্নালিজমে মাষ্টার্স
করে ঢাকায় এসে ভাইয়ের সংসারের সদস্য হয়েছিল পান্না। ছোট্ট মেয়ে হিয়া আর
ভাবীকে নিয়ে ভাইয়ের সংসার। ভাগ্যবানদের মত একটি চাকুরীও জুটে গিয়েছিল
এনজিওতে। বেশ ভালই কাটছিল সময়। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ডাটা কালেকশন আর
রাতভর সে ডাটা থেকে রিপোর্ট তৈরী। প্রতিদিন ডাটা সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র
ধরণের মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে পান্নার। রাতে যখন রিপোর্ট তৈরীতে বসে তখন
চোখের সামনে ভেসে উঠে সারা দিনের বৈচিত্রে ভরা মানুষের চরিত্র। লেখক হতে
পারলে অনেক বড় বড় উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতো পান্না।
প্রতি দিনের
মত গত কাল গিয়েছিল ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে। আর সেখানে গিয়েই দেখা হয়
ফিরোজের সাথে। ফিরোজ ওর ক্লাসমেট। একই সাথে কলেজ পাশ করেছিল। তারপর আর দেখা
হয়নি। হঠাৎ ঐ আবাসিক হোটেলে ওকে দেখে চমকে উঠেছিল পান্না। অনেক আলাপের পর
ওর আগমনের কথা জানায় ফিরোজকে এবং ওর সাহায্য চায়। ফিরোজকে পান্না কথা দেয়
ওদের হোটেলের নাম রির্পোটে লিখবে না। ফিরোজ অনেক দিন পর ক্লাসমেটকে পেয়ে
খুব খুশি হয় আর সব রকম সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।
পান্না এসেছে
আবাসিক হোটেল গুলোতে যেসব মেয়ে দেহ বিক্রি করে, তাদের উপর একটি বাস্তব
সমীক্ষা চালাতে। কাজটি খুব সহজ নয়। কারণ এই কাজগুলো হয় গোপনে। প্রকাশ্যে
কেউ স্বীকার করে না যে হোটেলগুলোতে এইসব কাজ হয়। ফিরোজকে পেয়ে পান্না
আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশি হয়েছে। কারণ পরিচিত না হলে হোটেল গুলোর
বিজনেস সিক্রেট কেউ প্রকাশ করার কথা নয়। ফিরোজ ডিগ্রী পাশ করে অনেক
ঘোরাঘুরি করে ভাল কোন চাকুরী না পেয়ে শেষে এই হোটেল ম্যানেজারের চাকুরীটা
নেয়। বাস্তব খুবই কঠিন। ছাত্র জীবনে কতই না স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে
সম্মানজনক একটি চাকুরী করে দেশের সেবা করবে। কিন্তু এখন কি করতে হচ্ছে দুঃখ
করল পান্নার কাছে। ফিরোজের কাছ থেকে প্রাথমিক ধারণা পেয়েই পান্না ভিতরে
ভিতরে কেঁপে উঠলো দেশের অবস্থার কথা চিন্তা করে। সারা রাত ঘুমাতে পারলো না
পান্না। চোখের সামনে যে চিত্র ভেসে উঠলো তাতে ঘুম না আসারই কথা। প্রতি দিন
গড়ে ২০/২৫টি মেয়ে প্রতিটি হোটেলে আসে। শুধু ঢাকা সিটিতে যদি ২০০০টি হোটেল
ধরে হিসাব করা হয় তবে দেখা যাবে প্রতিদিন ৪০ হাজার মেয়ে হোটেলে দেহ বিক্রি
করছে। ফিরোজ জানালো শুধু ঢাকা শহরেই নয় সারা বাংলাদেশের আবাসিক হোটেল
গুলোতে এখন এটাই প্রধান বিজনেস। তাছাড়া আবাসিক এলাকায় স্বাভাবিক বসবাসরত
মানুষের মত বাড়ী ভাড়া করে এই ব্যবসা করছে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। এছাড়া
ভিআইপি এলাকায় যেমন গুলসান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরায় আছে
ভিআইপিদের জন্য এই সব ব্যবস্থা। আর সবচেয়ে আশংকাজনক বিষয় হচ্ছে
ভ্রাম্যমানদের নিয়ে। ওদের বিচরণ সর্বত্র। প্রতিটি জায়গায় ওদের দেখা যায়।
সন্ধ্যার পর একটু চেষ্টা করলেই আধো আলো আধো ছায়াযুক্ত জায়গায় ওদের দেখা
মিলবে। তাহলে? আমরা যে সভ্য সমাজের বড়াই করছি। প্রতিদিন মিটিং মিছিল করে
সমাজ গড়ার যে ভাষণ দিচ্ছি সেকি এই সমাজ গঠনের জন্য?
নিজের
অজান্তেই শিউরে উঠে পান্না। একবার মনে হয় ফিরোজের সাথে দেখা না হলেই বোধহয়
ভাল হতো। এতোদিন সমাজটাকে, সমাজের মানুষকে যেভাবে চিনত সেটাই ভাল ছিল। কেন
বাস্তবটা দেখতে গেল। কিন্তু তখনও পান্না জানতো না ওর জন্য আরও একটি কঠিন
বাস্তব অপক্ষা করছে।
ভাবীর ধাক্কায়
ঘুম ভেঙ্গে উঠে ভাবতে চেষ্টা করল গত রাতের কথা। আজ আবার ফিরোজের সাথে দেখা
করতে হবে। ফিরোজ একটি মেয়ের সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেবে। পান্না যদি ওর কাছ
থেকে কিছু তথ্য বের করতে পারে তবেই সাকসেস। সাধারণতঃ মেয়েরা কারো কাছে মুখ
খোলে না। পান্না চেষ্টা করবে ওর ব্যবহার আর মিষ্টি কথা দিয়ে মেয়েটির মনের
কথা বের করতে।
একটি মেয়ের
সাথে এক রুমে একান্তে বসে আলাপ করবে ভাবতেই পান্নার মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে
গেল। মেয়েটি ভাববে অন্যান্য লোকের মত পান্নাও একজন খরিদ্দার। ওকে ভোগ করার
জন্য এসেছে। রুমটি ছোট্ট। একটি খাট, পরিপাটি করে বিছানা পাতা, পাশে একটি
টেবিল। টেবিলে একটি পানির বোতল ও গ্লাস রাখা। জানালায় পর্দা আঁটা, ঘরে একটি
বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। ঘরে ঢুকেই পান্না দেখতে পেলো একটি মেয়ে খাটের উপর
বসে আছে। ফিরোজকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। আর তখনই ঘটলো ঘটনাটি।
ফিরোজ অনেকণ
কিসব বলে গেল। পান্না বা মেয়েটির কানে সেসব কথা ঢুকলো না। মেয়েটি অপলক
দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পান্নার দিকে আর পান্না মেয়েটির দিকে। ফিরোজ ঘর থেকে
বেরিয়ে যাওয়ার পরও ওরা স্বাভাবিক হতে পারলোনা। কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে কেউ বলতে
পারবে না। হঠাৎ মেয়েটির কথায় পান্না নিজেকে ফিরে পেলো।
'আপনি এখানে?'
পান্না কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু ওর কন্ঠ থেকে কোন শব্দ বের হলো না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেয়েটিকে আবিস্কারের প্রথম ক্ষনটি।
পান্না মাত্র
চাকুরী পেয়ে মনযোগ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে একান্ত অবিডিয়েন্ট ছাত্রের মত।
অনেক রাত পর্যন্ত ওকে রিপোর্ট লিখতে হতো। সে দিনও ও একটি রির্পোট নিয়ে বেশ
টেনশনে ছিল। পর দিন জমা দিতে হবে। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। ঘড়িতে কয়টা বাজে
সেটা দেখারও সুযোগ হলো না। অগত্যা গরম থেকে বাঁচার জন্য বারান্দায় গিয়েই
আবিস্কার করলো একটি নারী মুর্তির। পাশের বাসার বারান্দার গ্রীল ধরে আকাশের
দিকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে। যতদুর দৃষ্টি যায় কোথাও বিদ্যুতের আলো দেখা
যাচ্ছিল না। কিন্তু চাঁদের আলোয় মেয়েটির চোখ দুটি চিক চিক করছিল। আজ প্রায় ৬
মাস হয় এসেছে এ বাড়ীতে কিন্তু কখনও দেখা হয়নি মেয়েটির সাথে। তবেকি মেয়েটি
নতুন এসেছে? বিদ্যুতহীন ঢাকা শহরকে এভাবে কখনও দেখেনি পান্না। আকাশের দিকে
তাকিয়ে দেখে বেশ বড় চাঁদ। তবে কি আজ পূর্ণিমা? চাঁদের মিষ্টি আলোয় আর গভীর
রাতে কোলাহলমুক্ত ঢাকা শহরে এমনটি দৃশ্য ভাবাই যায়না। অনেকণ হয়ে গেল মেয়েটি
এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একটুও নড়াচড়া করছে না। যেন পাথরের
একটি মূর্তি। হাত ঘড়িটা তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করে পান্না কটা বাজে? সেকি
রাত ৩টা। এতো রাতে মেয়েটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে? একটু অস্বাভাবিক মনে হলো
পান্নার কাছে। ও মেয়েটির প্রতি আগ্রহশীল হয়ে উঠলো। চাঁদের আলোয় চেহারাটি
স্পষ্ট দেখা না গেলেও যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় মেয়েটি অপূর্ব
সুন্দরী। ওর চোখ দুটি যেন পদ্ম ফুলের মত। হঠাৎ বেরসিকের মত বিদ্যুৎ এসে
গেল। চারিদিকে আবার কৃত্রিম আলোয় ভরে গেল। মেয়েটির ধ্যান ভেঙ্গে গেল। নড়ে
উঠে এদিকে তাকাতেই পান্নার সাথে ওর চোখের মিলন ঘটলো। অবাক দৃষ্টিতে চেয়েছিল
মেয়েটি। অপূর্ব সে দৃষ্টি। মানুষের চোখ এত সুন্দর হয় পান্না কখন কল্পনাও
করেনি। একটুক্ষন মাত্র। মেয়েটি চোখ দুটি নামিয়ে ঘরে চলে গেল। আর রেখে গেল
পান্নার অবিবাহিত জীবনে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে
পান্না ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
অনেক রাত
পর্যন্ত জেগে জেগে কাজ করাই ছিল পান্নার রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু এখন আরও একটি
কাজ বেড়ে গেছে। ঘরে ঢুকেই চোখদুটি চলে যায় পাশের বাড়ীর বারান্দায়। আর
তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজতে থাকে। মাঝে মাঝে অনেক রাতে যখন সারা শহর
নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে পড়ে তখন একটি ছায়া মূর্তি এসে দাঁড়ায় বারান্দার গ্রীল
ধরে। আর বৃষ্টি ভেজা পদ্মের মত চোখ দুটি মেলে ধরে আকাশের দিকে। পান্না তখন
আর কাজে মন বসাতে পারে না। লাইট অফ করে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেও যেন ওর
সাথে আকাশের মেঘের মাঝে কি যেন খুঁজতে থাকে। কথা হয় না। কোন ইশারা হয়না।
কিন্তু দুটি হৃদয়ের মধ্যে যেন কথা হয়। অবাক চাহনি আর নিরবতা যেন ওদের ভাষা।
মাঝে মাঝে মনে হয় ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু পরক্ষণেই ভয় এসে বাসা বাধে
পান্নার মাঝে। কথা বলতে গেলে যদি হারিয়ে যায়। ওকে হারানোর চেয়ে কথা না বলাই
যেন ভাল। এভাবে নিরবেই কেটে যাচ্ছিল ওদের সময়। কিন্তু আজ হঠাৎ ওকে ফিরোজের
হোটেলে দেখে সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। বলার ভাষা হারিয়ে হৃদয়ের আকাশে
ঘনকালো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। চোখের সামনে বসে থাকা মেয়েটি আর রাতে
দেখা নারী মূর্তির সাথে কোন মিল খুঁজে পেলোনা পান্না।
'আপনি এখানে' আবার বললো মেয়েটি।
তারপরও কোন
কথা বলতে পারে না পান্না। মেয়েটি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সেই চাহনি। বৃষ্টি
ভেজা পদ্মের মত দুটি চোখ। না ভুল হয়নি। সেই তো? গত রাতেও ওকে আকাশের দিকে
তাকিয়ে থাকতে দেখেছে।
'বুঝেছি। আচ্ছা আমি চলি' মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।
'একটু বসুন। যাবেন না।' পান্না কোন রকমে কথা কয়টি বলে।
মেয়েটি বিছানায় বসে পড়ে।
'আমাকে দেখে
খুব অবাক হয়েছেন? অবাক হবার কিছু নেই। আপনাদের মত ভদ্র লোকেরাই আমাদের এ পথ
বানিয়ে দিয়েছে। তাই অবাক হবার ভান করবেন না। যে কাজে এসেছেন তাই করুন। আর
যদি পছন্দ না হয় আমাকে যেতে দিন।' ঝাঝালো কন্ঠে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে
কথাগুলো।
'আমি, মানে আপনি যা ভাবছেন তা নই। মানে আমি আপনাকে ভোগ করতে আসিনি। আমি এসেছি........'
'এখানে যারা
আসে তাদের একটিই উদ্দেশ্য। নারী দেহ ভোগ করা। আপনি সাধু পুরুষ নাকি?'
মেয়েটি এবার বেশ রেগে কথাগুলো বলে। এক মূহুর্তের জন্য মেয়েটিকে অপরিচিত মনে
হয় পান্নার।
পান্না নিজেকে
কিছুটা মানিয়ে নিয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে বসে। বুঝিয়ে বলে ওর আসার উদ্দেশ্য।
মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একসময় ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। দুচোখ বেয়ে অঝোর
ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। পান্না কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। কি করবে
কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটি অনেকক্ষণ পর উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি
ছিটিয়ে আসে। পান্না মেয়েটির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। প্রসাধনহীন এই
সুন্দর চেহারাটি এতোক্ষণ প্রসাধনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। মেয়েটি খাটের এক পাশে
বসে ঘরের লাইটের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বলতে শুরু করে-
'আমার বয়স যখন
৯ বৎসর তখন আমার মা একটি মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে মারা যান। বাবা ডিসি অফিসে
কেরানীর চাকুরী করতেন। রংপুর জেলা শহরে আমাদের একটি ছোট্ট বাড়ী আছে। আমার
মা সেই ছোট্ট বাড়ীটা মায়া মমতা আর স্নেহের পরশ দিয়ে ভরে রাখতেন। বাবা মায়ের
একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমি ছিলাম তাদের চোখের মনি। আমার চোখের সৌন্দর্যের
জন্য আমার নাম রেখেছিলেন সুনয়না। একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য মাকে জীবন
দিতে হল। মা চলে যাবার পর বাবা আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি। কিন্তু
আত্মীয় স্বজনের চাপে পড়ে বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎমা প্রথম প্রথম বেশ
ভালবাসতো আমাকে। বছর না ঘুরতেই একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে আমার উপর
চালাতে লাগলেন চাপা অত্যাচার। বুঝলেন না ? সকলের সামনে খুব ভাল কিন্তু
অগোচরে অকথ্য নির্যাতন। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল আমার দারুন
আগ্রহ, ছাত্রী হিসাবেও বেশ ভাল ছিলাম। সবকিছু সহ্য করে এস.এস.সি পরীক্ষা
দিলাম। ঠিক তখনই আমার জীবনে নেমে এলো পরিবর্তন। বাবার একজন সহকর্মী ঢাকা
থেকে এসে আমাদের বাড়ীতে উঠলেন। ২/৩ দিন থাকার সুবাদে আমাদের পরিবারের সাথে
তার একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাকে বশ করে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বয়সে
আমার দ্বিগুন হলেও ঢাকার পাত্র হাতছাড়া করার মত বোকামী মা করতে দিলেন না
আমার বাবাকে। ঢাকার ঐ লোকটার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। তিনি বিয়ের দিনই
আমাকে নিয়ে রাতের কোচে ঢাকায় রওনা দিলেন। ঢাকা আমার কল্পনার শহর। দুচোখ ভরে
সকালের ঢাকা দেখলাম। একটি সুন্দর বাড়ীতে আমাকে নিয়ে এলেন আমার স্বামী।
বাড়ী দেখে আমার খুব পছন্দ হলো। দুঃখ কষ্ট কিছুটা চলে গেল মন থেকে। সন্ধ্যার
পর আমার স্বামীর ২/৩ জন বন্ধু এলো আমাকে দেখতে। রাতে বাহির থেকে খাবার
কিনে আনা হলো। সবাই ধুমধাম করে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেল। আমার বাসর রাত।
মনের মধ্যে ১৭ বছরের পুঞ্জিভূত আশা-আকাংখা আর ভয় নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম
স্বামীর আগমনের জন্য। স্বামী এলো। আমাকে একটি ট্যাবলেট দিয়ে বললো - তোমার
শরীরের উপর অনেক ধকল গেছে। এটা খেয়ে নাও বেশ ভাল লাগবে। আমি সরল বিশ্বাসে
স্বামীর দেয়া ট্যাবলেটটি খাই। কিছুক্ষন পর আমার ভীষণ ঘুম পায়। অনেক চেষ্টা
করেও আর জেগে থাকতে পারিনি। যখন আমার ঘুম ভাংলো তখন আমার কাছে মনে হলো আমি
যেন অনেক ভারী একটি পাথরের নীচে পড়ে আছি। অনেক চেষ্টা করেও নড়া চড়া করতে
পারছিলাম না। ধীরে ধীরে অনেক চেষ্টা করে উঠে বসতেই অনুভব করলাম আমার শরীরের
উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের আলামত। বিছানায় রক্তের দাগ। আস্তে আস্তে বুঝতে
পারলাম কি হয়েছে। তখনও আমি সবটুকু বুঝতে পারিনি। স্বামীবর এসে আমাকে অনেক
আদর করে গোসল করে ফ্রেস হতে বললেন। শারীরিকভাবে আমি খুবই অসুস্থতা বোধ
করছিলাম। কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলাম না। পর দিনও ঘটলো অনুরূপ ঘটনা। শরীরের
ব্যথা কমে যাবে বলে দুটি ট্যাবলেট খাওয়াল। যথারীতি আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর কি হয়েছিল আমি জানি না। এভাবে ৭দিন চলে যাবার পর আমার শরীর ভীষণ
খারাপ হয়ে গেল। আমাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন বয়স্ক মহিলাকে আনা হলো।
মহিলাকে জড়িয়ে ধরে যখন খুব কাঁদলাম তখন উনি আমাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললেন।
আমার স্বামী নামক ব্যক্তিটির আরও ২টি বউ আছে। তাদেরকে দিয়েও আমার মত একই
কাজ করছে। এটাই তার পেশা। কি করবো, কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করে আবার আমাকে সুসথ করে হানিমুন করার জন্য
কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানেও তার সাথে ছিল কয়েকজন বন্ধু। আগের মতই
আমার অজান্তে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ওরা ব্যবহার করতো আমাকে। খুব অল্প সময়ের
মধ্যে আমি কিশোরী থেকে একজন নারীতে পরিনত হলাম।
প্রতিবাদ করার
মত আমার কোন শক্তি ছিল না। কারণ আমার অজান্তে আমাকে নেশা জাতীয় কিছু
খাওয়ানো হতো। রাত হলেই আমি পুরুষ মানুষের সাহচর্য পাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে
যেতাম। যতণ আমাকে অত্যাচার করা না হতো ততণ আমার শরীরের মধ্যে কামড়াতে
থাকতো। জীবনের চরম পরিনতিতে এসেও যখন ওদের চক্রান্ত থেকে নিজেকে বাঁচাতে
পারছিলাম না তখন ওদের কথামত চলতে রাজি হলাম। ওরা আমাকে কিছুটা স্বাধীনতা
দিল। এখন আমাকে মাঝে মাঝে বিদেশ যেতে হয় অন্য মানুষের বৌ সেজে আর হোটেলে
আসতে হয় সপ্তাহে ২ দিন। বাকী সময়টা ঐ বাড়ীতে থাকি। এই হচ্ছে আমার নষ্ট
জীবনের কষ্টের ইতিহাস। আমি জানি আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন। তাতে আমার কিছু এসে
যাবে না। তবে একটি কথা জেনে যান আমাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই বাড়া যদি
থামাতে না পারেন তবে হয়তো বা একদিন নিজের আপনজনকে এই কাজে দেখবেন তখন করার
কিছুই থাকবে না। '
দরজা খুলে
সুনয়না বেরিয়ে গেল। পান্না পাথরের মূর্তির মত বসেই রইল। শুধু ওর কানে বাজতে
থাকলো সুনয়নার শেষ সংলাপ 'একদিন যখন আপনজনকে এই কাজে দেখবেন তখন কিছুই
করার থাকবে না'।