রিয়াপুর বোকামি বলেই যখন ভেবেছিল ঠিক তখনি এ চিঠিটা বিরাট ধাক্কা হয়ে লাগলো তার ছোট বোন পিয়ার বুকে।
রিয়াপুর বিয়ে হয়েছিল পাচ বছর আগে।
দুলাভাই ভালো মানুষ। আপুকে খুব ভালোবাসতেন।
রিয়াপু একটু সেন্টিমেন্টাল টাইপের। অল্পতেই কেদে ফেলতো। কিন্তু বিয়ের পর সেই অভিমানি মেয়েটা অনেক বদলে গেল।
মা-বাবাও নির্ভার হলেন।
রিয়াপু যৌথ পরিবারে থাকলেও সকলকে ভালোই মানিয়ে নিল।
উচ্ছ্বল হাসি-খুশি হয়ে উঠলো।
দুই-তিন বছর ভালোই কাটলো। তারপর ক্রমেই যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকতো।
দুলাভাইকে জিজ্ঞাসা করা হলো। দুলাভাইও কিছু বুঝতে পারেন না বলেছিলেন।
পিয়া জিজ্ঞাসা করলেও ম্লান হেসে বলতো, কিছু না।
একদিন মেয়েকে চেপে ধরলেন মা, তিন বছর হয়ে গেল। এখন তো একটা সন্তান দিতে পারিস।
রিয়া মাথা নিচু করে বললো, চাইছি তো, হচ্ছে না।
মা জিজ্ঞাসা করেন, ডাক্তার কি বলে?
রিয়া বললো, ডাক্তার বলেন, কোনো অসুবিধা নেই।
এবারে সবাই বুঝলো তার দুঃখের কারণটা।
রিয়াআপুকে জড়িয়ে ধরেন মা। আরে, এর জন্য মন খারাপ করতে আছে? ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তোর শ্বশুরবাড়িতে কি কেউ কিছু বলে?
না না। তবে সকলে সন্তান হলে খুশি হতো।
কেন আপু, তোমার ভাসুরেরই তো মেয়ে আছে একটা। পিয়া বললো।
দুর পাগলি, সন্তান একটা থাকলে কি আর লাগে না?
দেখতে দেখতে আরো দুই বছর কেটে গেল। তার সন্তান হলো না। রিয়া ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যেতে লাগলো।
তার স্বামী তাকে কতো বোঝালেন। কিন্তু রিয়ার মুখে হাসি ফোটে না।
এবারে মা-বাবাও চিন্তিত হন। মেয়েটা আগেও বড্ড অভিমানি ছিল, মাঝখানে বদলেছিল। হাসি-খুশি উচ্ছ্বল ছিল। এখন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। মনে হয়, সারাক্ষণই কি ভাবে! জামাই তো ওকে অবহেলা করে না। তবে কেন এমন হচ্ছে! শ্বশুরবাড়িতে কি তাহলে ওকে কথা শোনাচ্ছে? ওদের বড় ছেলে অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে বৌ আর একটা মেয়ে রেখে। বৌটা অল্প বয়সী, বেশ সুন্দরী দেখতে। তারও আর সন্তানের আশা নেই। এ জন্য কি রিয়ার কাছে ওদের বংশধরের আশা একটু বেশি। কিন্তু ও যা চাপা স্বভাবের! বলবে না কিছুতেই।
শেষে মা-বাবা জামাইকে বলে কিছুদিনের জন্য নিয়ে এলেন রিয়াকে। ভাবলেন, পুরনো পরিবেশে এলে ওর ভালো লাগবে।
দুই বোনে গল্প করতো ঠিকই কিন্তু রিয়াপু এতো অন্যমনস্ক থাকে যে, কথা বলে আরাম পেত না পিয়া। ও অনেক বোঝায়, আপু, কেন তুমি এমন করছ? দেখছ না, দুলাভাইও তোমার অবস্থা দেখে মন খারাপ করছেন। তিনি তো তোমাকে কতো ভালোবাসেন! সন্তান না হওয়ার জন্য দোষারোপ করছেন কখনো?
তা করেনি। তবে ...। কি যেন বলতে গিয়েও রিয়া থেমে যায়। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।
মা-বাবা ওকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
সেখানে একদিন গিয়ে আর কিছুতেই গেল না রিয়া। বরং কেদে-কেটে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে চাইছিল।
শেষে সকলে ওকে অনেক অনুনয় করে থামায়।
কয়েকদিন পর এলো সেই মর্মান্তিক দিনটা।
বাড়ির সকলে মিলে টিভি দেখছিল ড্রয়িংরুমে বসে।
রিয়ার ভালো লাগছিল না বলে শুয়ে ছিল রুমের দরজা ভিড়িয়ে।
অনুষ্ঠান শেষ হলে কাজের মেয়ে টেবিলে ভাত দিয়ে খেতে বসতে ডাকলো সবাইকে। রিয়াকে ডাকতে যেই রুমে ঢুকেছে সেই সঙ্গে সঙ্গে এক চিৎকার দিল।
সকলে পড়িমড়ি করে ছুটলো। দেখলো রিয়া ফ্যানের সঙ্গে ওড়না লটকিয়ে ফাস নিয়েছে।
ওদের হই চইয়ে সকলে ছুটে এলো। ফ্যান থেকে রিয়াকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালো।
প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেব হাতের নাড়ি দেখে বললেন, সব শেষ।
নাহ! কোনো চিকিৎসার সুযোগ রিয়া দেয়নি কাউকে।
খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল ওর শ্বশুরবাড়ির সকলে।
দুলাভাইয়ের প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা কাদতে কাদতে।
নাহ! পুলিশে বিশেষ হয়রান করেনি। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ, অনুযোগ ছিল না।
অবশেষে ওর লাশ ভালোভাবে দাফন হয়েছিল।
মা-বাবা আকস্মিক এই ঘটনায় শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন।
পিয়ার শুধু আফসোস হতে লাগলো। টিভি না দেখে কেন আপুর সঙ্গে থাকলো না।
ছোট ভাইটা কেদে কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেললো।
দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেল।
দুলাভাই নিয়মিত আসতেন এখানে। আপুর জন্য আক্ষেপ করতেন।
সকলেই ভাবতো, রিয়া বোকামি করেছে। এ রকম স্বামীর সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে পারতো।
না হোক ছেলেমেয়ে, আপু তো দুলাভাইয়ের নামেও কোনো কমপ্লেইন করেননি কখনো। সে রকম হলেও তো ওকে অন্তত বলতো। ভাবতো পিয়া।
এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল দুলাভাই বিয়ে করেছেন তার ভাবীকে। তিনি নিজে এসে ওদেরকে নিমন্ত্রণ দিলেন বিয়ের। বললেন, মা-বাবা মানছেন না। বলছেন, বাইরের একটা মেয়ে বিয়ে করার চেয়ে ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তানটাও বাবা পাবে।
অন্যরা কিছু না বললেও পিয়া বলে বসলো, দুলাভাই, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন আপুকে?
না না কি বলছ, ওকে কি ভোলা সম্ভব?
বাবা বাধা দিলেন, ছিঃ মা! ওভাবে বলতে নেই। জামাইয়ের কিইবা বয়স। সারা জীবন পড়ে রয়েছে। এতো বরং ভালোই হলো। মেয়েটার একটা গতি হলো।
এরপর একদিন বৌ নিয়ে মা-বাবাকে সালাম করে গেলেন আর ওকে গল্পের কয়েকটি বই দিয়ে দুলাভাই বললেন, তোমার আপুর বই। তুমিও তো বই ভালোবাসো। তাই তোমাকেই দিলাম। আমাদের তো পড়া হয় না।
হায়! তখন কি পিয়া জানতো দুলাভাই কি দিয়ে যাচ্ছে?
বইগুলো তাকে সাজিয়ে রেখেছিল পিয়া।
সেদিন কি মনে হতেই বইগুলো বের করে কাপড় দিয়ে ঝাড়তে লাগলো। হঠাৎ করেই একটা বই থেকে টুক করে পড়লো ভাজ করা একটা কাগজ। কাগজটা তুলে ভাজ খুলেই পাথর হয়ে গেল। গোটা গোটা অক্ষরে ওর নাম লেখা।
রিয়াপুর লেখা চিঠি চিনতে দেরি হলো না। নিচে নাম ছিল না। অসমাপ্ত বলেই হয়তো।
পিয়া
তোকে কখনো চিঠি লিখবো ভাবিনি। সব সময়ই তো দেখা হচ্ছে, ফোনে কথা বলি। নিজের মনটা হালকা করার জন্যই এই লেখা। হয়তো এটা কখনো তোকে দেবো না।
তোরা ভাবিস, আমি সন্তান না হওয়ার দুঃখেই বোধহয় মন খারাপ করে রাখি। আসলে তা নয়, তোর দুলাভাইয়ের অভিনয় আর প্রতারণা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। তোদের মতো আমিও জানতাম, ও আমাকে বড্ড ভালোবাসে। অন্যরা সন্তান না হওয়ার জন্য কথা শোনালেও ও কখনো শোনায়নি। বরং বলেছে, আমি তোমাকে নিয়েই সুখী, সন্তান না হোক।
এক রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি ও পাশে নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ চলে যাওয়া সত্ত্বেও না আসায় খটকা লাগলো। উঠলাম। দেখলাম বাথরুমেও নেই। তারপর দরজা খুলে চারদিকে তাকালাম। হঠাৎ দেখলাম বড়ভাবীর রুম থেকে ও বেরিয়ে আসছে।
আমি দ্রুত এসে শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল যেন অজ্ঞান হয়ে যাবো। আর কেউ হলে তখনি ঝগড়া লাগিয়ে একটা কা- করতো। কিন্তু আমি নিজেই গুটিয়ে গেলাম। মাঝে মধ্যেই ওই রুমে যেতো ও। আবার দিনের বেলা এতো ভালোবাসার কথা বলতো যে, আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। ওদের দুজনকে কিছুই বলতে পারতাম না।
তোরা বলতিস, আমি খুব ইমোশনাল মেয়ে। কিন্তু বিয়ের পর আমি তো বদলে ফেলেছিলাম নিজেকে। তারপরও কেন আমার সঙ্গে এ প্রতারণা! আচ্ছা, আমি এমন কেন বলতে পারিস? কোথায় ওদের লজ্জা দেবো তা নয়, নিজেই লজ্জা-অপমানে মরে যাচ্ছি। আচ্ছা, আমার কি এখন ওদের পথ থেকে সরে দাড়ানো উচিত?
চিঠিটা অসমাপ্তই রয়ে গেছে।
পিয়া রাগে ফুসতে থাকলো, আহারে, আপু কতো মনঃকষ্ট নিয়েই না পৃথিবী থেকে চলে গেল! দুলাভাই কি করে করলেন এতো বড় প্রতারণা? নাহ! ওদের দুজনকে ছেড়ে দেয়া যায় না। বিবেকের দংশনে হলেও ওদের পোড়াতে হবে।
মা-বাবাকে বলে পুরনো দুঃখ বাড়িয়ে কি লাভ? তাই পরদিন গিয়ে হাজির হলো রিয়ার শ্বশুরবাড়িতে।
ওরা দুজন তখন বিকেলের নাশতা খাচ্ছিল। পিয়াকে দেখে অবাক হলো।
এসো এসো, অনেক দিন তো আসো না। ভাবলাম, আমাদের ভুলেই গেছ। দুলাভাই বললেন।
দুলাভাইয়ের কথার পিঠে পিয়া হাসলো, সব যদি ভুলতে পারতাম আপনার মতো ...।
কি বলছ তুমি!
নাহ! ঠাট্টা করলাম।
তারপর চা-নাশতা খেয়ে আসার সময় চিঠিটা সে দুলাভাইকে দিয়ে বললো, আপনার জন্য সারপ্রাইজ, পড়ে দেখুন দুজনে।
আর পেছনে না তাকিয়ে পিয়া চলে এলো ।
ইচ্ছা হচ্ছিল ওদের চেহারাটা একটু দেখতে। কিন্তু ও তো রিয়াপুর মতো নয়। রাগের চোটে হয়তো সিন কৃয়েট করে ফেলতে পারে।
তার চেয়ে এটাই তো ভালো হলো। নিরীহ রিয়াপুর সঙ্গে যে প্রতারণা করেছিল সে জন্য ওদের দাম্পত্য সুখের মধ্যেও অহরহ এ চিঠিটা বিবেকের হুল হয়ে সব সময়ই ফোটাতে থাকবে।
রিয়াপুর বিয়ে হয়েছিল পাচ বছর আগে।
দুলাভাই ভালো মানুষ। আপুকে খুব ভালোবাসতেন।
রিয়াপু একটু সেন্টিমেন্টাল টাইপের। অল্পতেই কেদে ফেলতো। কিন্তু বিয়ের পর সেই অভিমানি মেয়েটা অনেক বদলে গেল।
মা-বাবাও নির্ভার হলেন।
রিয়াপু যৌথ পরিবারে থাকলেও সকলকে ভালোই মানিয়ে নিল।
উচ্ছ্বল হাসি-খুশি হয়ে উঠলো।
দুই-তিন বছর ভালোই কাটলো। তারপর ক্রমেই যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকতো।
দুলাভাইকে জিজ্ঞাসা করা হলো। দুলাভাইও কিছু বুঝতে পারেন না বলেছিলেন।
পিয়া জিজ্ঞাসা করলেও ম্লান হেসে বলতো, কিছু না।
একদিন মেয়েকে চেপে ধরলেন মা, তিন বছর হয়ে গেল। এখন তো একটা সন্তান দিতে পারিস।
রিয়া মাথা নিচু করে বললো, চাইছি তো, হচ্ছে না।
মা জিজ্ঞাসা করেন, ডাক্তার কি বলে?
রিয়া বললো, ডাক্তার বলেন, কোনো অসুবিধা নেই।
এবারে সবাই বুঝলো তার দুঃখের কারণটা।
রিয়াআপুকে জড়িয়ে ধরেন মা। আরে, এর জন্য মন খারাপ করতে আছে? ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তোর শ্বশুরবাড়িতে কি কেউ কিছু বলে?
না না। তবে সকলে সন্তান হলে খুশি হতো।
কেন আপু, তোমার ভাসুরেরই তো মেয়ে আছে একটা। পিয়া বললো।
দুর পাগলি, সন্তান একটা থাকলে কি আর লাগে না?
দেখতে দেখতে আরো দুই বছর কেটে গেল। তার সন্তান হলো না। রিয়া ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যেতে লাগলো।
তার স্বামী তাকে কতো বোঝালেন। কিন্তু রিয়ার মুখে হাসি ফোটে না।
এবারে মা-বাবাও চিন্তিত হন। মেয়েটা আগেও বড্ড অভিমানি ছিল, মাঝখানে বদলেছিল। হাসি-খুশি উচ্ছ্বল ছিল। এখন কেমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। মনে হয়, সারাক্ষণই কি ভাবে! জামাই তো ওকে অবহেলা করে না। তবে কেন এমন হচ্ছে! শ্বশুরবাড়িতে কি তাহলে ওকে কথা শোনাচ্ছে? ওদের বড় ছেলে অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে বৌ আর একটা মেয়ে রেখে। বৌটা অল্প বয়সী, বেশ সুন্দরী দেখতে। তারও আর সন্তানের আশা নেই। এ জন্য কি রিয়ার কাছে ওদের বংশধরের আশা একটু বেশি। কিন্তু ও যা চাপা স্বভাবের! বলবে না কিছুতেই।
শেষে মা-বাবা জামাইকে বলে কিছুদিনের জন্য নিয়ে এলেন রিয়াকে। ভাবলেন, পুরনো পরিবেশে এলে ওর ভালো লাগবে।
দুই বোনে গল্প করতো ঠিকই কিন্তু রিয়াপু এতো অন্যমনস্ক থাকে যে, কথা বলে আরাম পেত না পিয়া। ও অনেক বোঝায়, আপু, কেন তুমি এমন করছ? দেখছ না, দুলাভাইও তোমার অবস্থা দেখে মন খারাপ করছেন। তিনি তো তোমাকে কতো ভালোবাসেন! সন্তান না হওয়ার জন্য দোষারোপ করছেন কখনো?
তা করেনি। তবে ...। কি যেন বলতে গিয়েও রিয়া থেমে যায়। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।
মা-বাবা ওকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
সেখানে একদিন গিয়ে আর কিছুতেই গেল না রিয়া। বরং কেদে-কেটে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে চাইছিল।
শেষে সকলে ওকে অনেক অনুনয় করে থামায়।
কয়েকদিন পর এলো সেই মর্মান্তিক দিনটা।
বাড়ির সকলে মিলে টিভি দেখছিল ড্রয়িংরুমে বসে।
রিয়ার ভালো লাগছিল না বলে শুয়ে ছিল রুমের দরজা ভিড়িয়ে।
অনুষ্ঠান শেষ হলে কাজের মেয়ে টেবিলে ভাত দিয়ে খেতে বসতে ডাকলো সবাইকে। রিয়াকে ডাকতে যেই রুমে ঢুকেছে সেই সঙ্গে সঙ্গে এক চিৎকার দিল।
সকলে পড়িমড়ি করে ছুটলো। দেখলো রিয়া ফ্যানের সঙ্গে ওড়না লটকিয়ে ফাস নিয়েছে।
ওদের হই চইয়ে সকলে ছুটে এলো। ফ্যান থেকে রিয়াকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালো।
প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেব হাতের নাড়ি দেখে বললেন, সব শেষ।
নাহ! কোনো চিকিৎসার সুযোগ রিয়া দেয়নি কাউকে।
খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল ওর শ্বশুরবাড়ির সকলে।
দুলাভাইয়ের প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা কাদতে কাদতে।
নাহ! পুলিশে বিশেষ হয়রান করেনি। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ, অনুযোগ ছিল না।
অবশেষে ওর লাশ ভালোভাবে দাফন হয়েছিল।
মা-বাবা আকস্মিক এই ঘটনায় শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন।
পিয়ার শুধু আফসোস হতে লাগলো। টিভি না দেখে কেন আপুর সঙ্গে থাকলো না।
ছোট ভাইটা কেদে কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেললো।
দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে গেল।
দুলাভাই নিয়মিত আসতেন এখানে। আপুর জন্য আক্ষেপ করতেন।
সকলেই ভাবতো, রিয়া বোকামি করেছে। এ রকম স্বামীর সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে পারতো।
না হোক ছেলেমেয়ে, আপু তো দুলাভাইয়ের নামেও কোনো কমপ্লেইন করেননি কখনো। সে রকম হলেও তো ওকে অন্তত বলতো। ভাবতো পিয়া।
এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল দুলাভাই বিয়ে করেছেন তার ভাবীকে। তিনি নিজে এসে ওদেরকে নিমন্ত্রণ দিলেন বিয়ের। বললেন, মা-বাবা মানছেন না। বলছেন, বাইরের একটা মেয়ে বিয়ে করার চেয়ে ঘরের মেয়েকে বিয়ে করলে সন্তানটাও বাবা পাবে।
অন্যরা কিছু না বললেও পিয়া বলে বসলো, দুলাভাই, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন আপুকে?
না না কি বলছ, ওকে কি ভোলা সম্ভব?
বাবা বাধা দিলেন, ছিঃ মা! ওভাবে বলতে নেই। জামাইয়ের কিইবা বয়স। সারা জীবন পড়ে রয়েছে। এতো বরং ভালোই হলো। মেয়েটার একটা গতি হলো।
এরপর একদিন বৌ নিয়ে মা-বাবাকে সালাম করে গেলেন আর ওকে গল্পের কয়েকটি বই দিয়ে দুলাভাই বললেন, তোমার আপুর বই। তুমিও তো বই ভালোবাসো। তাই তোমাকেই দিলাম। আমাদের তো পড়া হয় না।
হায়! তখন কি পিয়া জানতো দুলাভাই কি দিয়ে যাচ্ছে?
বইগুলো তাকে সাজিয়ে রেখেছিল পিয়া।
সেদিন কি মনে হতেই বইগুলো বের করে কাপড় দিয়ে ঝাড়তে লাগলো। হঠাৎ করেই একটা বই থেকে টুক করে পড়লো ভাজ করা একটা কাগজ। কাগজটা তুলে ভাজ খুলেই পাথর হয়ে গেল। গোটা গোটা অক্ষরে ওর নাম লেখা।
রিয়াপুর লেখা চিঠি চিনতে দেরি হলো না। নিচে নাম ছিল না। অসমাপ্ত বলেই হয়তো।
পিয়া
তোকে কখনো চিঠি লিখবো ভাবিনি। সব সময়ই তো দেখা হচ্ছে, ফোনে কথা বলি। নিজের মনটা হালকা করার জন্যই এই লেখা। হয়তো এটা কখনো তোকে দেবো না।
তোরা ভাবিস, আমি সন্তান না হওয়ার দুঃখেই বোধহয় মন খারাপ করে রাখি। আসলে তা নয়, তোর দুলাভাইয়ের অভিনয় আর প্রতারণা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। তোদের মতো আমিও জানতাম, ও আমাকে বড্ড ভালোবাসে। অন্যরা সন্তান না হওয়ার জন্য কথা শোনালেও ও কখনো শোনায়নি। বরং বলেছে, আমি তোমাকে নিয়েই সুখী, সন্তান না হোক।
এক রাতে ঘুম ভাঙলে দেখি ও পাশে নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ চলে যাওয়া সত্ত্বেও না আসায় খটকা লাগলো। উঠলাম। দেখলাম বাথরুমেও নেই। তারপর দরজা খুলে চারদিকে তাকালাম। হঠাৎ দেখলাম বড়ভাবীর রুম থেকে ও বেরিয়ে আসছে।
আমি দ্রুত এসে শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল যেন অজ্ঞান হয়ে যাবো। আর কেউ হলে তখনি ঝগড়া লাগিয়ে একটা কা- করতো। কিন্তু আমি নিজেই গুটিয়ে গেলাম। মাঝে মধ্যেই ওই রুমে যেতো ও। আবার দিনের বেলা এতো ভালোবাসার কথা বলতো যে, আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। ওদের দুজনকে কিছুই বলতে পারতাম না।
তোরা বলতিস, আমি খুব ইমোশনাল মেয়ে। কিন্তু বিয়ের পর আমি তো বদলে ফেলেছিলাম নিজেকে। তারপরও কেন আমার সঙ্গে এ প্রতারণা! আচ্ছা, আমি এমন কেন বলতে পারিস? কোথায় ওদের লজ্জা দেবো তা নয়, নিজেই লজ্জা-অপমানে মরে যাচ্ছি। আচ্ছা, আমার কি এখন ওদের পথ থেকে সরে দাড়ানো উচিত?
চিঠিটা অসমাপ্তই রয়ে গেছে।
পিয়া রাগে ফুসতে থাকলো, আহারে, আপু কতো মনঃকষ্ট নিয়েই না পৃথিবী থেকে চলে গেল! দুলাভাই কি করে করলেন এতো বড় প্রতারণা? নাহ! ওদের দুজনকে ছেড়ে দেয়া যায় না। বিবেকের দংশনে হলেও ওদের পোড়াতে হবে।
মা-বাবাকে বলে পুরনো দুঃখ বাড়িয়ে কি লাভ? তাই পরদিন গিয়ে হাজির হলো রিয়ার শ্বশুরবাড়িতে।
ওরা দুজন তখন বিকেলের নাশতা খাচ্ছিল। পিয়াকে দেখে অবাক হলো।
এসো এসো, অনেক দিন তো আসো না। ভাবলাম, আমাদের ভুলেই গেছ। দুলাভাই বললেন।
দুলাভাইয়ের কথার পিঠে পিয়া হাসলো, সব যদি ভুলতে পারতাম আপনার মতো ...।
কি বলছ তুমি!
নাহ! ঠাট্টা করলাম।
তারপর চা-নাশতা খেয়ে আসার সময় চিঠিটা সে দুলাভাইকে দিয়ে বললো, আপনার জন্য সারপ্রাইজ, পড়ে দেখুন দুজনে।
আর পেছনে না তাকিয়ে পিয়া চলে এলো ।
ইচ্ছা হচ্ছিল ওদের চেহারাটা একটু দেখতে। কিন্তু ও তো রিয়াপুর মতো নয়। রাগের চোটে হয়তো সিন কৃয়েট করে ফেলতে পারে।
তার চেয়ে এটাই তো ভালো হলো। নিরীহ রিয়াপুর সঙ্গে যে প্রতারণা করেছিল সে জন্য ওদের দাম্পত্য সুখের মধ্যেও অহরহ এ চিঠিটা বিবেকের হুল হয়ে সব সময়ই ফোটাতে থাকবে।